গ্রামের মেঠো পথের দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে উঠে আসা একটি ছেলে নাম আবীর। সে খুবই ভালো ছেলে, ছোট বেলা থেকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তো, বাবা-মা আত্মীয় স্বজনের কাছেও সে খুবই প্রিয়, ভালো ছেলে হিসেবে সকলে আবীরকে এক নামে চিনে ও জানে। গ্রামের ছোট বড় সকলেই আবীর কে ভালোবাসতো। গরীব ঘরের সন্তান বলেই পড়াশুনার পাশাপাশি কিছু একটা করতে পারাটাই আবীরের লক্ষ্য। ঢাকায় এসে আবীর চাকুরীর সন্ধানে হর্ণে হয়ে খোজাখুজি করতে লাগলো, কোথায় চাকুরী না পেয়ে অবশেষ নয়পল্টনের একটি থ্রি-ষ্টার হোটেলে ওয়েটার হিসেবে চাকুরী পেয়ে গেল। কর্মক্ষেত্রে সে খুব ভালো সুনামের সাথে কাজ করছে। প্রতিদিনের মতই আজও নাইট ডিউটিতে গেলো। রাত প্রায় ১১ টা, ইভিনিং শিফটের ডিউটি প্রায় শেষ, নাইট শিফট এর কাজ শুরু হবে, আবীর এসে ইউনিফর্ম পরে রেডি হয়ে সবে রেষ্ট্রুরেন্টে প্রবেশ করল। এমন সময় ম্যানেজার সাহেব বললঃ-
- গুড ইভিনিং আবির
- হাউ আর ইউ
- ফাইন, থেংক ইউ।
- প্লিজ গীভ দ্যা বিল টু দ্যা ফ্রন্ট অফিস।
- ওকে বলে আবীর বিল নিয়ে যাচ্ছে ফ্রন্ট অফিসের দিকে.....
- সিঁড়ি দিয়ে নামতে যাবে হঠাৎ তার চোখে একটা আলোর ঝিলিক সিঁড়ির মাঝখান থেকে এসে ধরা দিল।
মাথাটা নিচু করে দেখলো এই যে একটা চেইন পড়ে আছে। প্রথম দেখায় একটু ইতস্তত করলো, মনে
মনে ভাবলো বাজারে স্বর্ণ হবে হয়তো। যা হোক আবীর তা কুঁড়িয়ে নিয়ে পকেটে ভরে নিল।
- ফ্রন্ট অফিস থেকে কাজ শেষে ফিরে এলো রেষ্ট্রুরেন্টে, কাজের ফাঁকে ফাঁকে বারবার দেখছে আবির
চেইনটিকে, মনে হচ্ছে খাঁটি স্বর্ণ, আবার চিন্তা করছে হয়তো বাজারে স্বর্ণ হবে। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল
যে, সে আগে যাচাই করবে যদি খাটি স্বর্ণ হয় তাহলে..........
- ভাবনায় পড়ে গেল আবীর, এই ভাবে কাজের ফাঁকে ফাঁকে নানান চিন্তা আবিরকে আচ্ছন্ন করতে
লাগলো। এই চেইনটি যদি স্বর্ণের হয় তাহলে তো অনেক টাকা বিক্রি করা যাবে, সে কি তা রেখে দিবে
না তা হোটেলের নিয়ম অনুযায়ী জমা দিয়ে দিবে। আবার আবীর ভাবতে লাগলো, মহান আল্লাহ তায়ালা
তাকে সুস্থ রেখেছে, তাকে একটি চাকুরীর ব্যবস্থা করে দিয়েছে, সবার কাছে তাকে সম্মানের পাত্র
বানিয়েছে এভাবে আল্লাহর দেয়া শুকরিয়া কথা মনে করে আবীর মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল যে, যদি তা
স্বর্ণের চেইন হয় তাহলে তা সে হোটেলে জমা দিয়ে দিবে ইত্যাদি ভাবতে ভাবতে এক সময় রাত
পেরিয়ে ভোর হয়ে গেল। ডিউটি শেষ করে এবার বাসায় যাওয়ার পালা। কিন্তু গেইট দিয়ে বের হতে
গেলে তো দারোয়ান চেক করবে। তাই আগের থেকেই চেইনটিকে স্বযত্নে রাখলো। গেট থেকে
বেরিয়ে আবির সিন্ধান্ত নিল যে, সে কোন স্বর্ণকারের দোকানে যাবে গত রাতের কুঁড়িয়ে পাওয়া চেইনটি
যাচাই করার জন্য।
- পল্টন মোড়ে নেমেই সে হাঁটতে লাগলো বাইতুল মোকাররম এর দিকে। কারণ সেখানে অনেক
নামী-দামী স্বর্ণের দোকান আছে। তাই সে ভাবলো অন্যরা হয়তো চিনতে পারবে না তাই সে সেখানে
যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল।
- দোকানী স্বর্ণের চেইনটিকে দেখে চিনতে পারলো। বলল ভাই বিক্রি করতে এসেছেন?
- আবীর বলল না। দোকানীকে জিজ্ঞেস করল এটা কি খাঁটি সোনার চেইন।
- দোকনী বললেন, বলেন কি আপনি স্বর্ণ চিনেন না! তারপর দোকানী বললেন ভাই এখানে ১ ভরি স্বর্ণ
আছে। আর এটি খাঁটি সোনার চেইন।
- আবীর এবার নিশ্চিত হলো যে, তার কাছে যা আছে তা সত্যিই সোনার চেইন, এতে আর কোন সন্দেহ
নেই।
- দিন শেষে রাত হয়ে গেলো। সারা দিন ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিল আবীর। শরীরের আড়মোড় ভেঙ্গে উঠল ঘুম
থেকে এবার ডিউটিতে যাওয়ার পালা।
- প্রতিদিনের মত আজও ডিউটিতে যাচ্ছে আবীর, গত রাতের পাওয়া সোনার চেইনটিকে সে কি করবে।
এই নিয়ে সে আবারো ভাবতে লাগল। আবীরের মনে ছিল আল্লাহ ভীতি, মান সম্মানকে সে খুব ভয় পায়,
ভাবছে হোটেলে এতো লোক থাকতে সে কেন এই চেইনটি পেল। অন্য কেউও এই সোনার চেইনটি
পেলে হয়তো নিজের কাছে রেখে দিত। কিন্তু আবীরের সামনে পড়লো কেন? হয়তো আল্লাহ তাকে
পরীক্ষা করছেন। এইভাবে চিন্তা করতে করতে সে হোটেলে পৌঁছে গেল।
- সে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে !!!!!
- হোটেলে গিয়ে সে সোজা ম্যানেজার কে ডাকলো, তারপর সুপারভাইজারকে, বলল স্যার আমি গত রাতে
সার্ভিসে থাকা অবস্থায় এই সোনার চেইনটি পেলাম। আমি নিশ্চত ছিলাম না যে, এটা সোনার চেইন।
তাই আমি নিশ্চিত হয়ে এখন এটা হোটেলের নিয়ম অনুযায়ী “লষ্ট এন্ড ফাউন্ড” (হোটেলে আগত
অতীথিদের হারানো মাল জমা দেওয়ার ফান্ড) এ জমা দিতে চাই।
- এই বলে আবীর সোনার চেইনটি ম্যানেজারের দিকে বাড়িয়ে দিল।
- ম্যানেজার ও সুপারভাইজার এই কান্ড দেখে হা করে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ!!! ভাবছে তারা এই
পৃথিবীতে সৎ মানুষ তাহলে এখনো আছে! তারপর তারা আবিরকে বাহঃ বাহঃ দিল।
থেংকস, থেংকস বলে পিঠে হাত বুলিয়ে দিল.....
- ম্যানেজার আবীরের হাত থকে সোনার চেইনটি নিয়ে নাম, তারিখ ও সময় লিখে একটি
খামের মধ্যে পুরে নিল। নিয়ে হোটেলের ডি.জি.এম স্যারকে গিয়ে বলল, স্যার গত রাতে এই সোনার
চেইনটি পাওয়া গেছে। এখন তা লষ্ট এন্ড ফান্ডে জমা দিব, আপনাকে জানানোর জন্য এসেছি। স্যার
বিস্তারিত সব জেনে বলল ঠিক আছে।
- কেটে গেল তিন মাস, আবীর প্রতিনিয়তই ডিউটি করে যাচ্ছে। ঐদিনের পর থেকে আবীরের সহকর্মীরা
ও আবিরকে অন্য চোখে দেখছে, তার প্রতি যেন সকলের ভালোবাসা আরো বেড়ে গেল।
- ২০০৬ সালের ২৬ মার্চ হোটেলের বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠান। সেদিন হোটেলে এক জমকালো অনুষ্ঠানের
আয়োজন করা হয়েছে। হোটেলের ছোট থেকে বড় সকল কর্মকর্তা/কর্মচারী উপস্থিত আছে ব্যানকুয়েট
হলে। এছাড়া প্রতিটি স্টাফের আত্মীয় স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সহ শত শত মানুষের ঢল হোটেলে, সকলের
কোলাহলে ব্যানকুয়েট হল যেন আনন্দের বন্যা বইছে।
- মালিক পক্ষ ও এক্সিকিউটিববৃন্দ তাদের আসন গ্রহণ করেছে। আর হোটেলের ডি.জি.এম স্যার
উপস্থাপনা করছেন। এভাবে নানাবিধ আলোচনা/পর্যালোচনায় এগিয়ে চলছে সময়....
- গত এক বছরের নানাহ কার্যক্রম, সফলতা ও বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা চলছে। এক পর্যায়ে ডি.জি.
এম স্যার বক্তব্য রাখছেন। এক সময় তিনি সততা নিয়ে কথা বলতে লাগলেন। জীবনে সৎ থাকলে
উন্নয়ন সম্ভব, সৎ ব্যক্তিকে সকলে ভালোবাসে, আল্লাহর কাছেও সে সম্মানিতদের একজন ইত্যাদি নানা
প্রশংসার কথা বলতে বলতে আবীরের প্রসঙ্গটা উঠে এলো সকলের মাঝে। ডি.জি.এম স্যার খুবই
আগ্রহের সাথে আবীরের কথাটা তুলে ধরলো সকলের মাঝে।
- তিনি বললেন আমাদের মাঝে এমন একটি ছেলে আছে যে নাকি এক চরম সততার পরিচয় দিয়েছে।
- এভাবে তিনি পুরো ঘটনা ঐ অনুষ্ঠানে বর্ণনা করলেন এবং বর্ণনা শেষে আবীরকে সকলের সামনে
দাঁড়াতে বললেন। পরে তাকে মঞ্চে নিয়ে গেলেন। সেদিন ডি.জি.এম স্যার ঘোষণা করলেন সকলকে
আবীরের জন্য করতালি দিয়ে শুভেচ্ছা জানাতে, সকলে আবীরকে করতালি দিয়ে শুভেচ্ছা জানিয়েছে।
- আজকের এই মুহূর্ত যেন আবীরের জীবনের এক স্মরণীয় দিন, আবির খুশিতে আত্মহারা, আবীর
আনন্দে কেঁদে ফেললো, এ যেন এক আনন্দের কান্না.............
- তারপর হোটেলের মালিকগণ তাঁকে কাছে নিয়ে আদর করলেন, সকলের সামনে ঘোষণা করলেন যে
আজ থেকে আবির আমাদের গর্ব, তাকে এই হোটেলের পক্ষ থেকে একটা সততার উপর “সততার
সম্মাননা পুরস্কার-২০০৬” দেয়া হবে এবং তাকে পদোন্নতি ও বেতন বৃদ্ধিসহ নানান সুযোগ-সুবিধা
দেওয়া হবে ইত্যাদি........
শিক্ষনীয় বিষয়ঃ- যারা আল্লাহকে ভয় করে, রাসূলের সুন্নাতকে মেনে চলে ও পরকালে আল্লাহর সমীপে নিজের জীবনের হিসাবের কথা চিন্তা-ভাবনা করে। তাদের জন্য মহান আল্লাহ তায়ালা দুনিয়াতেও পুরস্কার রেখেছেন, আর আখেরাতে এর চাইতে আরো উত্তম কিছু দান করবেন। আসি আজ থেকে আমরা সকলের জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সৎ জীবন যাপন করার সংকল্প করি।
মাশ-আল্লাহ!
খুবই ভালো লিখেছেন! সততা মানুষের সম্মান বৃদ্ধি করে! আর ঈমান মানুষকে খাঁটি মানুষ করে গড়ে তুলতে সহায়তা করে! আবীবের মত সন্তান পৃথিবীর সকল ঘরে ঘরে জন্ম হোক! আর তাদের পিতা-মাতাগণ তাকে নিয়ে গর্ববোধ করুক!
▬▬▬▬▬▬▬▬ஜ۩۞۩ஜ▬▬▬▬▬▬▬▬
স্বপ্নের বাঁধন
▬▬▬▬▬▬▬▬ஜ۩۞۩ஜ▬▬▬▬▬▬▬▬
সৎকর্মে মন আনন্দিত হলে বলা হয়েছে যে, তা ঈমানের পরিচায়ক।
সত্যিই, নিজেকে সৎ হিসেবে তুলে ধরতে পারলে এবং তা যদি স্বীকৃতি পায় তাহলে আনন্দ তো দ্বিগুণ হয়ে উঠে। তবে মনে রাখতে হবে যেন রিয়া আক্রমণ না করে।
আমরা সবাই কিন্তু নিজেদের কাজে-কর্মে এমন সততার পরিচয় খুব সহজেই দিতে পারি। কিন্তু দিনে দিনে আমাদের অসৎগুণগুলো সততার উপর শক্তিশালী হয়ে গেছে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অবক্ষয়ের মাধ্যমে। তাই কেউ কোথাও সততার পরিচয় দিলে তাকে আমরা অসাধারণ মনে করি, অথচ এটা হওয়া উচিত ছিল অতি সাধারণ।
"নির্মাণ ম্যাগাজিন" ©www.nirmanmagazine.com
খুবই চমৎকার। তবে, দুর্ভাগ্যজনক ভাবে এই ধরণের ঘটনা মুসলিম অধ্যুষিত একটি সমাজে সাধারণ ঘটনা হবার কথা ছিল। আজ আমরা প্রকৃত ইসলাম ও ইসলামী মূল্যবোধ থেকে এত দূরে যে, এইসব ঘটনাগুলোকে রূপকথা মনে হয়।
খুব সুন্দর
_______________
ধন্যবাদান্তে
(শরিফুল ইসলাম শরীফ)
ফেসবুকে আমি