১৯৭২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি রক্ষীবাহিনী গঠিত হয়। গঠনের পর থেকেই এ রক্ষীবাহিনী সবসময় সরকার প্রধানের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে থেকে কাজ করেছে। রক্ষী বাহিনী গঠন সম্পর্কে এনায়েতুল্লাহ খান লিখেছেনঃ 'একটি বিশেষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত এই এলিট ফোর্স সৃষ্টির ইতিহাস আরো বিচিত্র। মুজিব বাহিনীর নেতৃবৃন্দের পরিকল্পনা অনুযায়ী শেখ মুজিবর রহমানের স্বহস্তে লিখিত পত্রের ওপর ভিত্তি করে এবং তারি উত্তরাধিকারীদের নেতৃত্বে এই রাজনৈতিক বাহিনী গঠন করা হয়। এখানে উল্লেখ্য যে, দেরাদুনে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত এই বিশেষ প্রতিবিপ্লবী সংগঠন জেনারেল ওসমানী পরিচালিত মুক্তিবাহিনী এমন কি তাজুদ্দিনের নিয়ন্ত্রণেও ছিল না। জনৈক ভারতীয় সেনাবাহিনীর জেনারেল ওবানের প্রত্যক্ষ পরিচালনায় এর সাংগঠনিক কাঠামো এবং ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতে একথাই নিঃসন্দেহে প্রমাণ করে যে, জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের সংগে এই বাহিনীর মৌলিক বিরোধ ছিল।’ অন্যদিকে রক্ষীবাহিনীর অত্যাচার ও হত্যার লাইসেন্স দেয়া প্রসঙ্গে ১৯৭২ সালের ২ এপ্রিল সাপ্তাহিক হলিডে পত্রিকার ‘স্যাংশান টু দ্য কিল ডিসেন্টার’ শীর্ষক প্রবন্ধে বলা হয়, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব যখন প্রকাশ্যে জনসভায় নির্দেশ দিলেন, “নক্সালদের দেখামাত্র গুলী কর” তখন রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড চালানোর জন্য অন্য কোনো অনুমোদনের আর দরকার পড়ে না।’ এ পত্রিকার ১৯৭৩ সালের ২০ মে প্রকাশিত ‘ভিসেজ অব কাউন্টার রেভ্যলুশন’ শীর্ষক প্রবন্ধে বলা হয়, “রক্ষীবাহিনী হচ্ছে প্রতি বিপ্লবের অস্ত্র, যার উপর এমনকি সর্বভুক শাসক শ্রেণীর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। ভারতীয় শাসক শ্রেণীর অনুগত এক সরকারকে এবং ভারতীয় উপ-সাম্রাজ্যবাদের সম্প্রসারণবাদী স্বার্থকে রক্ষা করার জন্য এটা হচ্ছে সিআরপির সম্প্রসারণ। এর নিঃশ্বাসে রয়েছে মৃত্যু আর ভীতি। আপনি অথবা আমি যে কেউ হতে পারি এর শিকার এবং বাংলাদেশের প্রশাসনের পুস্তকে আমাদের পরিচিতি হবে ‘দুষ্কৃতকারী’ হিসাবে।” রক্ষীবাহিনীকে ইনডেমনিটি দেয়া প্রসঙ্গে সাবেক উপরাষ্ট্রপতি ও সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিষ্টার মওদুদ আহমদের লেখা, ‘শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনকাল’ বইয়ে উল্লেখ করা হয়-‘যখন রক্ষীবাহিনীর আচরণ এবং ভুমিকা নিয়ে জনগণের অসন্তোষ চরম পর্যায়ে উপনীত হয় এবং দেশের সংবাদপত্রগুলো তাদের ক্ষমতা, কতৃ ত্ব ও ভুমিকা নিয়ে অব্যাহতভাবে প্রশ্ন উত্থাপন করতে থাকে তখন ২০ মাস কার্যধারা পরিচালনায় ঢালাও লাইসেস দেয়ার পর সরকার রক্ষী বাহিনীর তৎপরতাকে আইনসিদ্ধ প্রতিপন্ন করার লক্ষ্যেও একটি অধ্যাদেশ জারি করে।’ আজকের পর্বে রক্ষীবাহিনীর বর্বরতার দুটি চিত্র তুলে ধরবো। ১. আমার সাথে যে ৪০জনের মতো ছেলে রাজনীতি করতো তারা সবাই ছিল ব্রিলিয়ান্ট, ফাস্টক্লাস পাবার মতো ছেলে। শুধু বেঁচে আছি আমি ও আরেকজন। বাকী সবাই রক্ষী বাহিনী, মুজিব বাহিনী ও মুজিবের অন্যান্য বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছে। এদের মধ্যে গৌতম দত্তকে গ্রেফতার করা হয় ঢাকায় এবং হত্যা করা হয় কাটুবুলিতে তার নিজের বাড়িতে নিয়ে। রশিদকে হত্যা করা হয় রামভদ্রপুরে নিয়ে। ডামুড্যার আতিক হালদার, ধনুই গ্রামের মোতালেব এদেরকেও তাদের বাড়িতে নিয়ে আত্মীয়স্বজনের সামনে হত্যা করা হয়। পঁচাত্তরের প্রথম দিকে মোহর আলীকে ধরেছিল পুলিশে। শিবচর থেকে তাকে নিয়ে গিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে। তার শরীরের চামড়া খুলে লবণ মাখিয়ে তাকে হত্যা করা হয় এবং তার লাশ ডামুড্যা বাজারে টানিয়ে রাখা হয় কয়েকদিন। .... আঘাত এলো সিরাজ সরদারের উপরে। তিনি পালিয়ে গিয়ে সিরাজ সিকদারের বাহিনীতে আশ্রয় নিলেন। সিরাজ সিকদার তাকে চারজন গার্ড দিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। একদিন তাকে ডেকে নিয়ে এলো। এরপর ঘেরাও করে প্রথমে তারা সিরাজ সিকদারের দেয়া চারজন গার্ডকে হত্যা করলো। আর সিরাজ সিরদারকে নিয়ে এলো নদীতে। নৌকার মাঝির বর্ণনামতে, প্রথমে তারা সিরাজ সরদারের হাতের কব্জি কাটল, তারপর পা ও অন্যান্য অংগ প্রত্যঙ্গ কেটে এবং শরীরের মাংস কেটে টুকরো টুকরো করে নদীতে ফেলে দিলো।‘ ( বামপন্থী নেতা শান্তি সেনের বর্ণনা) ২. মুক্তি পাবার পর আওয়ামী লীগ সরকারের অন্যায়-নির্যাতনের স্বরূপ প্রকাশের জন্য শ্রীমতি অরুণা সেনের সংবাদপত্রে একটি বিবৃতি দেন। তিনি বলেন, “গত ১৭ই আশ্বিন রক্ষীবাহিনীর লোকেরা আমাদের গ্রামের ওপর হামলা করে। ঐদিন ছিল দূর্গাপূজার দ্বিতীয় দিন। খুব ভোরে আমাকে গ্রেফতার করে। গ্রামের অনেক যুবককে ধরে বেদম মারপিট করে। লক্ষণ নামের একটি কলেজের ছাত্র ও আমাকে ধরে তারা নড়িয়া রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে আমাকে জিজ্ঞাসা করে আমার স্বামী শান্তি সেন ও পুত্র চঞ্চল সেন কোথায়? বলে তারা রাষ্ট্রদ্রোহী, তাদের ধরিয়ে দিন। আরো জিজ্ঞাসাবাদের পর সন্ধ্যার দিকে তারা আমাকে ছেড়ে দেয়। লক্ষণকে সেদিন রেখে পরদিন ছেড়ে দেয়। সে যখন বাড়ি ফেরে, দেখি বেদম মারের ফলে সে গুরুতররূপে আহত ও অসুস্থ হয়ে পড়েছে। চার/পাঁচ দিন পর আবার তারা আমাদের গ্রামের উপর হামলা চালায়। অনেক বাড়ি তল্লাশী করে। অনেককে মারধর করে। কৃষ্ণ ও ফজলু নামের দু’জন যুবককে তারা মারতে মারতে নিয়ে যায়। আজও তারা বাড়ি ফিরে আসেনি। তাদের আত্মীয়রা ক্যাম্পে গিয়ে তাদের খোঁজ করলে বলে দেওয়া হয় তারা সেখানে নেই। তাদেরকে খুন করে গুম করে ফেলা হয়েছে বলেই মনে হয়। এরপর মাঝে মাঝেই তারা গ্রামে এসে যুবক ছেলেদের খোঁজ করত। গত ৩রা ফেব্রুয়ারী ১৯৭৪ রাতে রক্ষীবাহিনী এসে সম্পূর্ণ গ্রামটিকে ঘিরে ফেলে। ভোরে আমাকে ধরে নদীর ধারে নিয়ে গেল। সেখানে দেখলাম, গ্রামের উপস্থিত প্রায় অধিকাংশ সক্ষম দেহী পুরুষ এমনকি বালকদের পর্যন্ত এনে হাজির করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের থানা সম্পাদক হোসেন খাঁ সবকিছুর তদারকি করছে। আমার সামনে রক্ষীবাহিনী উপস্থিত সকলকে বেদম মারপিট শুরু করে। শুনলাম এদের ধরতে গিয়ে বাড়ির মেয়ে-ছেলেদেরও তারা মারধর করে এবং অনেকক্ষেত্রে অশালীন আচরণ করেছে। এরপর আমাকে রক্ষীবাহিনীর কমান্ডার হুকুম করল পানিতে নেমে দাড়াতে। সেখানে নাকি আমাকে গুলি করা হবে। আমি নিজেই পানির দিকে নেমে গেলাম। ওরা রাইফেল উচিঁয়ে তাক করল গুলি করবে বলে। কিন্তু পরষ্পর কী সব বলাবলি করে রাইফেল নামিয়ে নিল। আমি কাঁদা-পানিতে দাঁড়িয়েই থাকলাম। কমান্ডার গ্রেফতার করা সবাইকে হিন্দু মুসলমান দুই কাতারে ভাগ করে দাড় করালো। মুসলমানদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা দিয়ে বলল, ‘মালাউনরা আমাদের দুশমন। তাদের ক্ষমা করা হবে না। তোমরা মুসলমানরা মালাউনদের সাথে থেকো না। তোমাদের এবারের মত মাফ করে দেয়া হল।’ এই বলে কলিমুদ্দিন ও মোস্তাফা নামের দু’জন মুসলমান যুবককে রেখে বাকি সবাইকে এক একটা বেতের বাড়ি দিয়ে বলল, ‘ছুটে পালাও’। তারা ছুটে পালিয়ে গেল। আমার পাক বাহিনীর কথা মনে পড়ল। তারাও বিক্ষুব্ধ জনতাকে বিভক্ত করতে এমনিভাবে সাম্প্রদায়িকতার আশ্রয় নিয়েছিল। পার্থক্য শুধু তারা ধর্মের নামে সাম্প্রদায়ীকতার আশ্রয় নিত আর এই ধর্মনিরপেক্ষতার ধব্জাধারীরা ভন্ডামীর আশ্রয় নিচ্ছে। আমাকে ছেড়ে দিয়ে ওরা কলিমুদ্দিন ও মোস্তাফাসহ ২০জন হিন্দু যুবককে নিয়ে রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্পের দিকে রওনা হল। তিনজন ছাড়া এরা সবাই পেশায় জেলে। মাছ ধরে কোনরকমে তারা জীবিকা নির্বাহ করে। তাদের আত্মীয়-স্বজনরা সব আকুল হয়ে কান্নাকাটি করতে থাকল। সে এক হৃদয় বিদারক দৃশ্য! সন্ধ্যার সময় কলিমুদ্দিন, মোস্তাফা, গোবিন্দনাগ ও হরিপদ ঘোষ ছাড়া বাকি সবাই গ্রামে ফিরে এল। আমি গেলাম তাদের দেখতে। দেখলাম তারা সবাই চলতে অক্ষম। সর্বাঙ্গ ফুলে গেছে তাদের। বেত ও বন্দুকের দাগ শরীর কেটে বসে গেছে। চোখ-মুখ ফোলা। হাতপায়ের গিরোতে রক্ত জমে আছে। তাদের কাছে শুনলাম, সারাদিন দফায় দফায় তাদের চাবুক মেরেছে। গলা ও পায়ের সঙ্গে দড়ি বেঁধে পানিতে বার বার ছুড়ে ফেলে ডুবিয়েছে। পিঠের নিচে ও বুকের উপর পা দিয়ে দু’দিক থেকে দু’জন লোক তাদের উপর উঠে দাড়িয়েছে। মই দিয়ে ডলেছে। এদের অনেককেই আত্মীয়রা বয়ে এনেছে। এদের অবস্থা দেখে মনটা খুবই খারাপ হয়ে গেল। ভাবলাম, যারা দিনরাত্রি পরিশ্রম করেও একবেলা পেটপুরে খেতে পায়না, অনাহার, দুঃখ-দারিদ্রের জ্বালায় আজ অর্ধমৃত তাদের ‘মরার উপর খাড়ার ঘাঁ’র অবসান কবে হবে? যে শাসকরা মানুষের সামান্য প্রয়োজন ভাত-কাপড়ের ব্যবস্থা করতে পারছে না, চুরি, ডাকাতি, রাহাজানী, শোষণ, নির্যাতন যারা বন্ধ করতে পারছে না, তারা কোন অধিকারে আজ নিঃস্ব মানুষের উপর চালাচ্ছে এই বর্বর নির্যাতন? অবশেষে চরম নির্যাতন আমার উপরও নেমে এল।
|
|||
Rate This |
||
|
প্লিজ প্লিজ প্লিজ! এত্ত বড় পোষ্ট না দিয়ে একটু একটু করে দিন। আমরা এত বড় জুলুমের ইতিহাস একসাথে হজম করতে পারছি না।
বজ্রকণ্ঠ থেকে বজ্রপাত হয় না, চিৎকার-চেঁচামেচি হয়; অধিকাংশ সময় যা হয় উপেক্ষিত।
ধন্যবাদ। কমিয়ে দিলাম।
লম্বা লম্বা পোষ্ট দেখলে প্রায়ই পড়ার সাহস হারিয়ে ফেলি। তখন মন্তব্য দিলেও দায়সারা গোছের দেয়া হয়। তদস্থলে ছোট আকারের পোষ্ট সহজেই পড়ে ফেলা যায়। আলোচনা করাও সহজ হয়।
ধারাবাহিক কতদূর চলবে?
রক্ষীবাহিনীর নির্যাতনের ভয়ে মানুষ চুপ করে সব সহ্য করেছে। মিডিয়াতেও সব খবর আসেনি। তাই পরবর্তীতে নির্যাতিতরা যেসব বক্তৃতা বিবৃতি দিয়েছেন এবং কিছু সাহসী মানুষ যেসব লোমহর্ষক কাহিনী লিখেছেন তার ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। তারপরও দেশের বাইরে থেকে সব তথ্য পাওয়া যায় না। তাই সিরিজ কতদূর যাবে এ মুহুর্তে বলা যাচ্ছে না।