আস্থার মিনারগুলো একে একে ভেঙ্গে ভেঙ্গে যায়। অর্থ আর প্রতিপত্তির পাহাড়ে চাপা পড়ে ছটফটিয়ে মরে বিশ্বাস। বিশ্বাস যেন শুধু বিশ্বাসঘাতকতারই হাতিয়ার। কারো প্রতি কোন দায়বদ্ধতা নেই, নেই মানবতা, নেই ভালোবাসা, চারিদিকে শুধুই স্বার্থপরতার দূর্ভেদ্য দেয়াল। অপারেশনের দুই বছর পর চৌগাছার শাহনাজ জানলেন তার একটি কিডনী নেই। কিডনীটি অপসারণ করা হয়েছে তার অনুমোদন ছাড়াই, অবৈধভাবে বিক্রি করে দিতেই চুপিসারে কিডনী অপসারণ করেছে ডাক্তার, দাবী শাহনাজের। তার এ দাবী একেবারে উড়িয়ে দেয়ার সাধ্য কি আছে কারো? বিশেষ করে ডাক্তাররা একের পর এক এমন সব অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন যে অনায়াসেই তাদেরকে কিডনীর অবৈধ ব্যবসার সাথে জড়িত বলে সন্দেহ করা যায়। অনেকেই জানেন, শিশু পাচারের উদ্দেশ্যের মধ্যে শরীরের বিভিন্ন অর্গান বিক্রি অন্যতম। আর বলাই বাহুল্য যে এসব কাজের সাথে ডাক্তারদের একটি নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে, বিশেষ করে ডাক্তারী বিদ্যা ছাড়া কিডনী কিংবা চোখ অপসারণ করা অসম্ভব। তাহলে যে ডাক্তারের কাছে মানুষ ছুটে যায় রোগমুক্তির আশায়, তারাই যদি আজরাইলের দায়িত্ব কাধে তুল নেয়, তাহলে সাধারণ মানুষের দাড়ানোর জায়গা কোথায়? কয়েকদিন আগে এই রাজধানী ঢাকার মালিবাগেই সিটি ডেন্টাল কলেজের শিক্ষানবিশ দাতের ডাক্তাররা জনতার ঘেরাওয়ের শিকার হন। কলেজের আশপাশ থেকে পশ শিশুদের ধরে ধরে, লোভনীয় খাবারের ফাঁদে ফেলে দাত তুলে নিয়মিত প্রাকটিস চালাতো ওরা। কারো অনুমোদনের তোয়াক্তা নেই, ভালো দাত, নষ্ট দাতের হিসেব নেই, ধরে ধরে দাত তুলে প্রাকটিশ যারা করতে জানে, কর্মক্ষেত্রে তারা কতটা নির্মম হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। বিশেষ করে শিশুদের প্রতি যাদের ন্যূনতম মমতা নেই তাদের পক্ষে অনৈতিক কোন কাজই করা অসম্ভব নয়। অর্থের পিছে পাগলা ঘৌড়ার মতো ছুটছে ডাক্তার সমাজ। তাই কখনো কখনো ডাক্তারদের প্রেসক্রিপশনে স্থান পায় ট্যাবলেট ক্যাপস্যুলের পরিবর্তে রড সিমেন্টের পরিমাণ। হয়তো বাচ্চাদের জন্য লিখে দেয়া হয় বড়দের ওষুধ। ডাক্তারদের অমন খামখেয়ালীর শিকার আমি নিজেও, শিকার আমার শিশু সন্তান। তাই অসুধ বিসুখ যদি মাত্রা না ছাড়ায় তবে এখন আর আমি ডাক্তারের শরনাপন্ন হই না, নিজের শরীরে প্রতি প্রতটুকু আস্থা আছে যে ছোটখাটো বিপদকে সে নিজেই প্রতিরোধ করতে হয়তো সক্ষম হবে। ইদানিং স্বাভাবিক প্রজনন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সিজার ছাড়া সন্তান ভূমিষ্ট করা যেন মহাপাপ। স্বাভাবিক একটি সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখাতে ডাক্তারকে হয়তো ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করতে হতে হয়, অত সময় ডাক্তারদের কোথায়? দিনে অন্তত এক ডজন অপারেশন করে গিনিজ বুকে নাম লেখাতেই তৎপর ডাক্তাররা। আর যতত সিজার, তত কাঁচা পয়সা। আমার স্ত্রীর সিজার হলো দুপুরে। এর আগে ডাক্তার আরো চারটি সিজার করেছেন, দুপুরের খাওয়ার সময় হয়ে গেছে। ডাক্তারের স্বামী এনেস্থেসিয়া স্পেশালিস্ট, তারপরও তাড়াহুড়ো করে ডাক্তার দম্পতি অপারেশন করলেন। পুরোপুরি অচেতন হওয়ার আগেই অপারেশন হলো, ভীতিকর একটি মৃত্যুযন্ত্রণা সয়ে প্রথম সন্তানের জননী হলো আমার স্ত্রী। সেদিন থেকেই দ্বিতীয় সন্তান নেয়ার ব্যাপারে জোড় আপত্তি তার। জেনেশুনে মৃত্যুর মুখে দু’বার কে পড়তে চায় বলুন। আমার কেন যেন সন্দেহ হয় শুধুমাত্র টাকার জন্য ডাক্তাররা সিজার করেন তা বোধহয় সত্যি নয়, টাকা প্রধান কারণ অবশ্যই। তবে আমার মনে হয় সরকারের পক্ষ থেকেও সিজার করার ব্যাপারে কোন নির্দেশনা আছে। সিজার করলে দু’টোর বেশি সন্তান নেয়া যায় না এমন একটি ধারণা সাধারণের মাঝে ব্যাপকভাবে প্রচলিত, তাই সিজারের মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে জন্মনিয়ন্ত্রণের জন্য সিজার করতে ডাক্তারদের নির্দেশ দেয়া হয় কিনা তা জানা দরকার। ডাক্তারদের সম্পর্কে আরেকটি অভিযোগ, তারা স্পষ্ট করে প্রেসক্রিপশন লেখেন না। যে যত বড় ডাক্তার তার হাতের লেখা ততটাই দূর্বোধ্য হবে এটাই যেন নিয়ম। ডাক্তারী প্যাঁচ শব্দটি তাদের এই দূর্ভোদ্য শব্দ লিখন থেকেই উৎপত্তি। ডাক্তারী প্রেশক্রিপশন নিয়ে যে ডিস্পেন্সারীতে ওষুধ কিনতে যাই সেখানে হয়তো বসে থাকে অর্ধশিক্ষিত কোন ব্যবসায়ী, তারপক্ষে হায়ারোগ্লিফিক্স কতটুকু পাঠোদ্ধার করা সম্ভব তা আমার বোধগম্য নয়, তবুও তারাই একমাত্র ভরসা। অথচ দেশের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্ররাই ডাক্তারী পেশাকে বেছে নেয়, কিংবা বলা যায় বেছে নেয়ার সুযোগ পায়। ভালো ছাত্রদের হাতের লেখা ভালো হওয়াই স্বাভাবিক, তবুও নিছক খেয়ালের বশেই কি তারা দূর্ভোধ্য ভাষায় প্রেশক্রিপশন লেখেন নাকি প্রেশক্রিপশনে লেখা ভুল ওষুধ খেয়ে কারো জীবনাবসান হলে প্রেশক্রিপশনের ওষুধের নাম পরিবর্তনের সুযোগ রাখতেই এ চেষ্টা, আল্লাহই ভালো জানেন। যদি প্রশ্ন করি, কোন পেশার লোকেরা সম্মানের সাথে ঘুষ খায়? অনেকেই হয়তো মন্ত্রী আমলাদের কথা ভাববেন। ঘুষকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছেন ডাক্তার সমাজ। শুধু প্রাতিষ্ঠানিক রূপদানই নয় বরং একে সামাজিকভাবে মর্যাদাও দিয়েছে। দেশের এমন একজন ডাক্তারও পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ, যারা বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানীর কাছ থেকে নিয়মিত ঘুষ নেন না। ডাক্তারের বাসার বাসন কোসন, ওভেন, সোফা, খাট পালঙ্ক, টিভি, ফ্রিজ, গাড়ী, এপার্টমেন্ট, প্লেনের টিকেট, মোট কথা এমন কোন ব্যবহার্য বস্তু নেই যা ডাক্তারদেরকে ঘুষ হিসেবে ওষুধ কোম্পানী উপহার দেয় না। আমার পরিচিত এক মেডিকেল রেপ্রেজেন্টাটিভের কাছ থেকেই জানতে পারি তারা শুধু আসবাবপত্র দিয়েই ক্ষ্যান্ত হন না বরং ডাক্তারদেরকে প্রতিমাসে নির্দিষ্ট অংকের নগদ টাকাও ঘুষ হিসেবে দিয়ে থাকে। অবশ্য এ ক্ষেত্রে শ্রেণীভেদ আছে, সব ডাক্তার সমান পরিমানে ঘুষ পান না, মর্যাদা অনুযায়ী ঘুষ তারা পেয়ে থাকেন। আমি একথা কিছুতেই বুঝতে পারি না যে দেশের সবচেয়ে মেধাবী যে ছাত্ররা ডাক্তার হচ্ছেন, তাদেরকে ওষুধের গুণাগুণ শেখায় সাধারণ ছাত্ররা, ওষুধ কোম্পানীর রিপ্রেজেন্টাটিভরা। এমআররা ডাক্তারদেরকে ঘুষ দিয়ে এতটাই পোষ মানিয়ে নেন যে প্রয়োজন হোক বা নাই হোক অবশ্যই কিছু ওষুধ তারা ধরিয়ে দেবেন এমআরদের খুশী করার জন্য। ডাক্তারদের কাছ থেকে বের হলেই রোগীকে ছেকে ধরে এমআরের দল, কি ওষুধ প্রেসক্রাইব করলেন ডাক্তার ঠিকই দেখে নেয় ওরা, লেদদেনের হিসেবটা মেলাতে ওরা ওস্তাদ। চিকিৎসা সেবা একটি মৌলিক অধিকার। ডাক্তাররা সে সেবাকে পণ্যে পরিণত করেছেন। টাকা ছাড়া চিকিৎসার সুযোগ নেই, সরকারী ওষুধও পাওয়া যায় না বিনে পয়সায়, অথচ টাকা হলেই মেলে পাশের ফার্মেসীতে। হাচি, কাশি যে কোন রোগেই গাদা গাদা টেস্টের পাহাড়ে চাপা পড়ে রোগীরা অকালে চলে যায় পরপারে। শুধুমাত্র প্যাথলজিগুলো থেকে কড়া হারে কমিশন খেতে চাপিয়ে দেয়া হয় পরীক্ষা নীরিক্ষার বোঝা। ক্লিনিকের রমরমা ব্যবসার ফাঁদে আটকে গেছে দেশের চিকিৎসার ব্যবস্থা। এর কি কোন সমাধান নেই? অসৎ ডাক্তারদের হাত থেকে, অর্থলোভী অমানুষদের হাত থেকে কি কিছুতেই নিস্তার নেই সাধারণ মানুষের? আমরা ডাক্তারের ছদ্মবেশে আজরাইলের হাতে মরতে চাই না, আমরা স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই।
|
|||
Rate This |
||
|
স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই।
ধন্যবাদ।
http://www.shahriar.info
আপনি হয়ত অবাক হবেন যারা এরকম ডাক্তারি পেশা নিয়ে ব্যবসা করে তারাই আবার মেডিকেল কলেজে হিরো সাজে। সর্বদা উপদেশ, উল্টা-পাল্টা টেস্ট দিলে নাম্বার কাটা যাবে, হ্যান্ড রাইটিং বুঝা না গেলে নাম্বার কমে যাবে,পেশেন্টের সাথে ভাল বিহেইব না করলে নাম্বার কমে যাবে...ইত্যাদি। আর যেসব ভুল-ভ্রান্তির কথা বললেন যে অপারেশানের পর গজ,তুলা,কাচি ফেলে আসা এটা তো গুরুতর অপরাধ ফরনেসিক মেডিসিনের ভাষায়। আমি ফরনেসিক মেডিসিন যতই পড়ছি ততই চিন্তা করছিএদেশে যেভাবে মেডিকেল প্র্যাকটিস চলছে সেই হিসাবে সবারই মেডিকেল প্রফেশান থেকে নাম কাটা যাবার কথা। আমার কথা না, ফরেনসিক মেডিসিনের কথা। কিন্তু সেটা হচ্ছেনা, কারণ আইন যদি সত্যি সত্যি এপ্লাই হয় তাহলে এদেশে আর ডাক্তার থাকবেনা । সবার রেজিস্ট্রেশান বাতিল হবে।
সমাধান? আসলে যেকোন প্রফেসানের জন্য প্রয়োজন নৈতিকতা। মেডিকেল প্রফেশানে সেটা আরো বেশি এপ্লিক্যাবল, কারণ এখানে জীবন-মরন সমস্যা। কিন্তু আমরা গোড়ায় পানি না ঢেলে শুধুই আগা পরিস্কার করছি। ফলে স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি মানুষ আর পাচ্ছেনা।
একটা ব্যাপার আমাদের সরকার কিন্তু কোন সাধারণ সমস্যা হলেও সরকারি হাসপাতালে আসেনা, তারা চলে যায় বিদেশ...কারণ কি???
shetu
ধন্যবাদ সেতু।
আপনি ঠিকই বলেছেন নৈতিকতা ছাড়া রাতারাতি এসব সমস্যার সমাধান আদৌ সম্ভব নয়।
আর যদি রাজনীতিবিদদেরকে সরকারী হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে বাধ্য করা যেত তবে এধরণের সমস্যা অনেক কমে যেত।
শুধু চিকিৎসা নয়, শিক্ষার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।
http://www.shahriar.info