আল্লাহ নাকি রিযিকদাতা, তাহলে মানুষ না খেয়ে মরে কেন? কেনইবা ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য এতো যুদ্ধ? প্রশ্নগুলো আমার এক ছাত্রের। প্রশ্ন একজনে উপস্থাপন করলেও একই জিজ্ঞাসা আরও ছয়জনের। আমি অবাক হইনি। কারন বাচ্চাদেরকে মায়ের উদরে শিক্ষাদানের কোনো ব্যবস্থা আল্লাহ করেননি। এ দায়ীত্ব আল্লাহ অর্পণ করেছেন পিতা/মাতা/অভিভাবক বা শিক্ষালয়ের উপর। তারা যদি এ দায়ীত্ব যথাযথ পালন না করেন তাহলে প্রশ্ন এমনটাই আসার কথা। যাহোক, প্রশ্ন যেহেতু আমাকে করা হয়েছে, উত্তর আমাকে দিতে হবে এবং তা কুরআন থেকে। আল্লাহর কৃপায় জওয়াবের সুত্র আমি পেয়েও গেলাম। সুরা হুদ এর ৬নং আয়াতে আল্লাহ দাবী করেছেন যে, ভূ-পৃষ্ঠে বিচরণকারী এমন কোন প্রাণী নেই, যার রিযকের দায়ীত্ব আল্লাহর উপর নেই। এ দাবী যে অকাট্য, তা আল্লাহর এ সৃষ্টিজগতে একটু তাকালেই বোঝা যায়। আকাশ ও যমিনে, বনে ও জংগলে মানুষ ছাড়া এই যে অগণিত প্রাণীকুল তারা কেউ চাষাবাদ করেনা। মানুষের মতো চাষাবাদের কোনো সরঞ্জামও তাদের নেই। কোনো ব্যবসা বানিজ্যর সিষ্টেম বা জ্ঞান বুদ্ধিও তাদেরকে দেয়া হয়নি। অথচ দেখা যায় সাঝের বেলা ঠিকই পেট পুরে খেয়ে দেয়ে সকলেই আপন আপন নীড়ে ফিরে যাচ্ছে। কিন্তু মানুষের বেলায় এমন কেনো? কেনো মানুষ না খেয়ে মারা যায়? অথচ জগতের সবকিছু আল্লাহ মানুষের খিদমাতের উদ্দেশ্যে সৃজন করেছেন। মানুষকে অন্য মাখলুকের প্রয়োজনে নয় বরং অন্যান্য সকল মাখলুককে তিনি মানুষের প্রয়োজনে পয়দা করেছেন বলে কুরআন কারিমে বার বার উল্লেখ করা হয়েছে (সুরা আল বাকারা ২৯, সুরা ইবরাহিম ৩২-৩৪)। তাহলে গলদটি কোথায়? বিষয়টি বুঝার জন্য একটি উদাহরণ দেয়া যাক: মিষ্টার X এর ছয়জন পুত্র সন্তান। তিনি ব্যবসা করেন। বলা যায়, সফল ব্যবসায়ী। সততার সুনামও আছে। সন্তানেরা সকলেই বিবাহিত, তাদের কারোর কারোর রয়েছে ছেলেমেয়েও। তারা সকলে একই বাড়িতে বাবা মায়ের সাথে থাকে ও খায়। রান্নাবান্নার কাজটি বউয়েরা করে। শাশুড়ী অর্থাৎ মিষ্টার X এর স্ত্রীর হাতে রান্নাঘরের যাবতীয় উপকরণ সরবরাহের দায়ীত্ব। যখন যা লাগে তা সবই তিনি যথাসময়ে সরবরাহ করেন, কোনরুপ কার্পণ্য করেননা। কিন্তু খাবার বন্টনের দায়ীত্বটি দিয়েছেন বড় বউয়ের হাতে। বড় বউ পরিবারের সদস্যরা খেতে বসার আগেই গোপনে মাছ, গোশত, তরিতরকারীর একটা বড় অংশ নিজ স্বামী ও সন্তানদের দিয়ে দেয়। এর ফল যা হবার তা-ই এবাড়ীতে ঘটছে। দেখা যায়, প্রায়ই অন্যরা তাদের ন্যায্য হিস্যা পায়না। কখনও বলা হয়, আজ গোশত কম ছিল, আজ মাছের বেশ কিছু টুকরা বিড়ালে খেয়ে ফেলেছে, আজ কিছু টুকরা কেরোসিন তেলে পড়ে গেছে, আজ হিসাবে ভুল হয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি। এ অবস্থার জন্য শাশুড়ী কিন্তু মোটেই দায়ী নন। কারন তিনি হিসাব করে প্রয়োজন মতো চাল, ডাল, তরিতরকারী, মাছ গোশত দিয়ে যাচ্ছেন। এর জন্য দায়ী হচ্ছে বড় বউ। এ জাতীয় বড় বউদের কারনে সমাজে কিছু লোক বেশী খায় বা নষ্ট করে আবার কিছু লোক না খেয়ে থাকে। এ দৃষ্টান্ত রাষ্ট্র পেরিয়ে আন্তজার্তিক পরিমন্ডল পযন্ত ব্যপ্ত। আরো একটি উদাহরণ দেয়া যাক: এক গবেষণায় দেখা গেছে, সৌদী আরবে যে পেট্রোল আছে ঠিক একই মুল্যমানের গ্যাস ছিল বাংলাদেশে। সৌদী আরবের সৎ ও আল্লাহভীরু নেতৃত্ব তাদের পেট্রোলকে কাজে লাগিয়েছে, আল্লাহ প্রদত্ত সে সম্পদের সুফল জনগনকে পাইয়ে দিয়েছে। অপরদিকে বাংলাদেশের অধিবাসীগন তাদের অসৎ ও দুর্ণীতিবাজ নেতৃত্বের কারনে সেই গ্যাস সম্পদের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। শুধু কি এটি? মেচের কাঠি খরচ হবে, তাই সারাদিন গ্যাসের চুলাটি জ্বালিয়ে রাখে এদেশের প্রায় অর্ধলাখ মানুষ। এ সৎকর্মটি চলছে এদেশে গ্যাস সংযোগের ঠিক শুরুর দিনটি থেকে। সুতরাং কেউ না খেয়ে মারা গেলে এ দোষ আল্লাহর – এ কথা বলা সঠিক নয়। জ্ঞান ও প্রজ্ঞা এজাতীয় চিন্তা চেতনাকে সমর্থন করেনা। আল্লাহ তায়ালা তার মাখলুকের জন্য প্রয়োজনমতো খাবার উৎপন্ন করার একটি সয়ংক্রিয় ব্যবস্থা চালু করে রেখেছেন। উৎপাদিত সে দ্রব্য-সম্ভার ন্যায় ও ইনসাফের সাথে বিলি বন্টনের যে বিধি পদ্ধতি তিনি তার নাবী রাসুলদের মাধ্যমে মানব সমাজে পাঠিয়েছেন সে বিধি পদ্ধতি মানুষ প্রয়োগ করেনা বলেই কিছু মানুষ না খেয়ে মরে আবার কিছু মানুষ খাবারের অভাবে চুরি করে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেছেন: “ঐ ব্যক্তি মু’মিন নয়, যে পেট পুরে আহার করে অথচ সে জানে যে তার প্রতিবেশী অভুক্ত” (তাবারানি, আল হাকিম। সত্যতা নিরুপণ: শাইখ আল বানি রাহ:)। আর একটি হাদিসে (হাদিসু কুদসী) এসেছে: “ রাসুলুল্লাহ সা: বলেছেন, আল্লাহ বলেন: “কিয়ামাতের দিন আল্লাহ বলবেন, হে আদাম সন্তান, আমিতো তোমার নিকট খাবার চেয়েছিলাম, তুমি আমাকে খাবার দাওনি। বান্দা বলবে: আপনি সারা বিশ্বের রব, আমি আপনাকে কিভাবে খাবার খাওয়াব? আল্লাহ বলবেন: তোমার নিকট কি আমার অমুক বান্দা খাবার চায়নি? তুমি যদি তখন তাকে খাবার খাওয়াতে তাহলে আজ তা আমার নিকট পেতে......” (মুসলিম)। ইসলামী জীবন ব্যবস্থা শুধুমাত্র দান সাদাকায় ধনীদেরকে উদ্বুদ্ধ করেই তার দায়িত্ব সমাপ্ত করেনি, ধনিক শ্রেণীর সম্পদ (যাকাত) বলপুবর্ক আহরণ করে অত:পর তা অভাবীদের মাঝে বন্টনের নির্দেশনাও দেয় এ দ্বীন। যাতে অভাব বা ক্ষুধার কষ্ট বলে কোথাও কিছু না থাকে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ইনতেকালের পর, আবু বকর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) এর খিলাফতকালে আবাস এবং জুবইয়ান গোত্রদ্বয় যাকাত দিতে অস্বীকার করে। তারা বললো নামায আদায়ে আমাদের কোনো আপত্তি নেই কিন্তু যাকাত দেবোনা। খলীফা আবু বকর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) এর কানে এখবর পৌছলে তিনি বললেন: “আল্লাহর কসম, যারা নামায এবং যাকাতের মধ্যে পার্থক্য করবে আমি অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবো” (বুখারী, মুসলিম)। তিনি এমনও বলেছিলেন: “আল্লাহর কসম, যাকাতের উট বাধার জন্যে যে রশিটি তারা রাসুল (সা) এর যামানায় প্রদান করতো এখন যদি তা দিতে এরা অস্বীকার করে তাহলেও আমি তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে যাবো”। আল্লাহর দেয়া আইন বিধান ফলো করলে সমাজে যে কেউ না খেয়ে থাকেনা তার জলন্ত প্রমাণ আল খুলাফা আর-রাশেদীন। উমাইয়া খলীফা সুলাইমান ইবনু আবদিল মালিক এর সময়ে যেখানে অভাবীরা যাকাতের জন্য লাইন দিতো, সেখানে তার মৃত্যুর পর তিন মাসের মাথায়ই উমার ইবনু আবদিল আযিযের সময়ে যাকাত নেবার জন্য লোক পাওয়া যেতোনা।
|
|||
Rate This |
||
|