যাকাতের বিধান, খাত ও এসম্পর্কিত যাবতীয় মাসায়েল একটি ব্যাপক ও জটিল বিষয়। এ ক্ষুদ্র পরিসরে তা তুলে ধরা সম্ভব নয়। তবে অধুনা অর্থ বিনিয়োগ বা লগ্নিকরণের নতুন নতুন খাত সৃষ্টি হওয়ায় যাকাত দাতাদের মধ্যে যে জিজ্ঞাসা ও দ্বিধা-দ্বন্ধের সৃষ্টি হচ্ছে তা নিয়ে মত বিনিময় করা পূণ্যের কাজ বলে আমি মনে করি। যেমন উদাহরণস্বরুপ নাবালেগের নামে বিভিন্ন ফিক্সড ডিপোজিট। বেশ কয়েকজনের সাথে আমি এ নিয়ে আলোচনা/অনুসন্ধান করেছি। কেউ বলেছেন: “টাকাটিতো নাবালেগের নামে, নাবালেগের কি যাকাত আছে”? কেউ বলেছেন: “এ টাকার যে যাকাত দিতে হবে তা আমি জানতামনা”। কেউ প্রশ্ন করেছেন: “শেয়ারেরও যাকাত আছে”? ইত্যাদি ইত্যাদি। যাহোক, সম্মানীত পাঠক/পাঠিকাদের সমীপে আলোচিত সে খাতসমুহ (ফকীহদের রায়সহ) আমি তুলে ধরছি: ইয়াতীমের সম্পদ/নাবালেগ সন্তানের নামে ব্যাংকে এফ ডি আর: যাকাত ফরজ তথা সাহিবে নিসাব হবার জন্য ৭টি শর্ত: (১) মুসলিম হওয়া (২) নিসাবের মালিক হওয়া (৩) নিসাব প্রকৃত প্রয়োজনের অতিরিক্ত হওয়া (৪) ঋণগ্রস্থ না হওয়া (৫) সম্পদ এক বছর স্থায়ী হওয়া (৬) জ্ঞান সম্পন্ন হওয়া (৭) বালেগ হওয়া। (তবে অনেক ফিকাহবিদের মতে যাকাত ফরজ হবার জন্য “জ্ঞান সম্পন্ন হওয়া” এবং “বালেগ হওয়া” জরুরী নয়)। কিছু বইয়ে এক কথায় জওয়াবও দেয়া হয়েছে যে, নাবালেগের উপর যাকাত নেই। এ ফতোয়ারই প্রেক্ষিতে যারা তাদের নাবালেগ সন্তানের নামে ব্যাংকে ‘এফ ডি আর’ ইত্যাদি করে রেখেছেন তারা কখনো যাকাত দেননা। (বলা আবশ্যক যে, এ ফতোয়ারই কারনে মাল সম্পদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ যাকাতের বাইরে লুকোচুরী করছে। আর ইসলাম বিরোধীদেরও একটা গ্রুপ এ ইস্যুকে কেন্দ্র করেই একথা বলার একটা সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে যে, “ইসলামতো পুজিবাদেরই আশ্রয়স্থল”)। এ ইস্যুতে প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ ও ফকীহগন যা বলেছেন: “নাবালেগ শিশুদের ব্যাপারে মতভেদ রয়েছে। একটা মত এই যে, ইয়াতীমের উপর যাকাত ওয়াজিব নয়। দ্বিতীয় মত হচ্ছে: ইয়াতীম বালেগ হওয়ার পর তার অলী তার সম্পদ তাকে হস্তান্তর করার সময় যাকাতের বিবরণ বলে দেবে, অত:পর সে (ঐ ইয়াতীম) তার নাবালেগ অবস্থার অর্থাৎ সময়কালের পুরো যাকাত আদায় করবে। তৃতীয় মত হচ্ছে: ইয়াতীমের মাল যদি কোন কারবারে লাগানো হয়ে থাকে এবং তার মুনাফা হয় তাহলে অলী এর যাকাত দেবে। চতুর্থ মত হচ্ছে: ইয়াতীমের মালের উপর যাকাত ওয়াজিব এবং তা দেয়ার দায়িত্ব তার অলীর। এ চতুর্থ অভিমত অধিকতর সঠিক। হাদিসে আছে: “সাবধান, যে ব্যক্তি এমন ইয়াতীমের অলী যার মাল আছে তার উচিত এ মাল দিয়ে কোনো ব্যবসা করবে, তা এমনি পড়ে থাকতে দেবেনা যাতে তার সব মাল যাকাতে খেয়ে না ফেলে” (তিরমিযি, বাইহাকী)। এর সম অর্থবোধক একটি মুরসাল হাদিস ইমাম শাফেয়ী এবং মারফু হাদিস তাবারানী ও আবু উবায়িদ থেকে বর্ণিত আছে। তার সমর্থন সাহাবী এবং তাবেঈদের দ্বারা পাওয়া যায় এবং যা উমার ইবনুল খাত্তাব, উম্মুল মু’মিনীন আয়িশা, আবদুল্লাহ ইবনু উমার, জাবির ইবনু আবদিল্লাহ (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) থেকে পাওয়া যায়। মস্তিস্ক বিকৃত লোকের সম্পর্কেও এ ধরণের মতভেদ আছে। এতেও আমাদের মতে সঠিক রায় হচ্ছে এই যে, পাগলের মালেরও যাকাত ওয়াজিব এবং তা আদায় করার দায়িত্ব অলীর”। (রাসায়েল ও মাসায়েল, দ্বিতীয় খন্ড পৃ: ১৩০ ১৩১) অতএব উপরের এ সকল আলোচনা থেকে আমার মতে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া অধিক ন্যায়সংগত এবং ইমান ও তাকওয়ার জন্যও অধিকতর নিরাপদ যে, ব্যাংকের সমুদয় ফিক্সড ডিপোজিটের যাকাত দিতে হবে। ব্যাংক, কোম্পানী ইত্যাদির শেয়ার: ইসলামী শারিয়াহ ভিত্তিক ব্যাংক এবং কোম্পানীর শেয়ারেরও যাকাত আছে। যাকাত ফরজ হবার দিন (অর্থাৎ এক বছর অতিক্রান্ত হলে) সেই সময়কার বাজার মুল্য অনুযায়ী সমুদয় শেয়ারের যাকাত দিতে হবে। অবশ্য শেয়ারহোল্ডারকে সাহিবে নিসাব হওয়া শর্ত। প্রভিডেন্ট ফান্ডের যাকাত: প্রভিডেন্ড ফান্ডের টাকা হাতে এলে তার যাকাত দিতে হবে। তবে কতৃপক্ষ তথা রাষ্ট্রের কোষাগারে থাকাবস্থায় এর কোন যাকাত নেই। ক্রীত প্লটের উপর যাকাত: যদি প্লট ক্রয়কালীন সময়ে এ নিয়াত থাকে যে, এখানে ভবিষ্যতে বাড়ী করে বসবাস করা হবে, তাহলে এ জমির যাকাত নেই। কিন্তু যদি এ অভিপ্রায় থাকে যে, দাম বাড়লেই এটি বিক্রয় করা হবে তাহলে স্বাভাবিক বাজার মুল্য অনুযায়ী বৎসরান্তে এর যাকাত দিতে হবে। তথ্যসুত্র: (১) রাসায়েল ও মাসায়েল – সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী (রাহিমাহুল্লাহ) (২) আসান ফেকাহ – মাওলানা ইউসুফ ইসলাহী (রাহিমাহুল্লাহ) (৩) আপনাদের প্রশ্নের জওয়াব – আল্লামা মুহাম্মাদ ইউসুফ লুধিয়ানাবী (রাহিমাহুল্লাহ) (৩) মাসিক পৃথিবী – ফেব্রুয়ারী ২০০১ এবং মে ২০০২ সাল বি: দ্র: (১) এখানে কেবলমাত্র ইসলামী ব্যাংকগুলোতে রাখা ডেপোজিটসমুহের কথা বলা হয়েছে। সুদভিত্তিক ব্যাংকের নয়। (২) আমার এ আলোচনার পাশে কারোর যদি কোনো সংযুক্তি/সংশোধন বা পরামর্শ থাকে তাহলে অতি আনন্দের সাথে তা আমি গ্রহণ করবো।
|
|||
Rate This |
||
|